-->
বঙ্গাব্দ
© Mehrab360

টাইটানের সলিল সমাধি | বিজ্ঞান যা বলে

© Mehrab360


গত ২৩ জুন টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া সাবমার্সিবল "টাইটান” এর বিভিন্ন অংশের টুকরা শনাক্ত করেছে কানাডার একটি "গভীর সমুদ্রের রোবট"। ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছেন আমেরিকান কোস্ট গার্ডের কমান্ডার। তিনি জানান, "টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে মাত্র ১৬০০ ফুট দূরে টাইটান সাবমার্সিবলের বিভিন্ন অংশ শনাক্ত করা গিয়েছে"। একই সাথে সাবমার্সিবলে থাকা ৫ যাত্রীকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে।


সংগৃহীত

একটু শুরু থেকে শুরু করা যাক। ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল দুপুরে যাত্রা করে দ্যা হোয়াইট স্টার লাইন কোম্পানি পরিচালিত জাহাজ টাইটানিক। যেটাকে তৎকালীন সময়ে অডুবনীয় জাহাজ বলে মনে করা হতো। কিন্তু যাত্রা শুরুর ৪ দিন পর ১৫ এপ্রিল উত্তর আটলান্টিক সাগরের বিশাল এক বরফের টুকরার সাথে ধাক্কায় জাহাজটি ডুবে যায়। টাইটানিক পরিণত হয় এক কিংবদন্তিতে। এরপর ১৯৯৭ সালে চলচিত্র পরিচালক জেমস ক্যামেরন পরিচালিত বিখ্যাত সিনেমা টাইটানিক মুক্তি পাওয়ার পর এ জাহাজটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তখন থেকেই মানুষের মনে টাইটানিক জাহাজ ভ্রমণের কৌতূহল জাগতে শুরু করে। এমনকি জেমস ক্যামেরন নিজেই সর্বমোট ৩৩ বার টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ ঘুরে এসেছেন।

এসব অভিযাত্রীদের কৌতূহল মেটাতে ২০২১ সাল থেকে টাইটানিকের উদ্দেশ্যে নিজেদের সাবমার্সিবলে অভিযাত্রা পরিচালনা করে আসছে ওশানগেট (OceanGate) নামক আমেরিকান প্রতিষ্ঠান। এবারের যাত্রায় যারা ছিলেন তারা হলেন Ocean- Gate এর সিইও স্টকটন রুশ, পাকিস্তানি ধনকুবের শাহাজাদা দাউদ এবং তার পুত্র সুলেমান দাউদ, ব্রিটিশ নাগরিক হ্যামিশ হারডিং, ফরাসি নাগরিক পল হেনরি নারজুলেট। গত ১৮ জুন, রবিবার বাংলাদেশ সময় বিকাল ৫ টায় পাঁচজন যাত্রী নিয়ে টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখার উদ্দেশ্যে সমুদ্রের প্রায় ১৩,০০০ ফুট গভীরে রওনা দেয় এ সাবমার্সিবলটি।


আমরা এখানে টাইটানকে সাবমেরিন না বলে সাবমার্সিবল কেন বলছি? কারণ এ দুটির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সাবমেরিন হলো স্বয়ংসম্পূর্ণ ডুবজাহাজ, যা নিজের শক্তিতেই সমুদ্রে চলতে পারে এবং গভীর সমুদ্রে গিয়ে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু সাবমার্সিবলকে সমুদ্র তলদেশে পাঠানোর জন্য এটিকে তার বাহক জাহাজে করে গন্তব্যে নিতে হয় এবং গভীর সমুদ্র থেকে ফিরে আসার পরে আবার • জাহাজে করেই বন্দরে নিয়ে আসা হয়। সাবমেরিনের নিজস্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু সাবমার্সিবল তার জাহাজের কন্ট্রোল রুমের সাথেই যোগাযোগ করতে পারে।

টাইটান সাবমার্সিবলটি দৈর্ঘ্যে ছিল ৬.৭ মিটার বা ২২ ফুট। এতে ৫ জন যাত্রীর জন্য ৪ দিন বা ৯৬ ঘণ্টার অক্সিজেন মজুদ করা ছিল। টাইটানের গঠন উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল কার্বন ফাইবার এবং টাইটানিয়াম ধাতু। যেগুলো অনেকক্ষেত্রেই পুরানো বিমানের অংশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। টাইটানের গতিপথ নিয়ন্ত্রণের জন্য ছিল একটি গেম কন্ট্রোলার বা জয়স্টিক। যদিও ডুবোজাহাজে জয়স্টিকের ব্যবহার নতুন নয়, মার্কিন নৌবাহিনীতে আগেই তা করা হয়েছিল। সমুদ্রের নিচে যেহেতু জিপিএস কাজ করেনা, তাই টাইটান তার কন্ট্রোল রুম থেকে পাওয়া টেক্সট মেসেজ অনুসরণ করে দিক ঠিক রাখতো। এর পৃষ্ঠে সেন্সর যুক্ত ছিল, যার মাধ্যমে সমুদ্র গভীরে এর উপর পানির চাপ কন্ট্রোল রুম থেকে পর্যবেক্ষণ করা হতো। সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাবমার্সিবলে চড়ে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে পৌছাতে সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা। এসময় এটি ঘণ্টায় ৪ কিমি বেগ তুলতে পারে। কিন্তু টাইটান শেষ যাত্রায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর তার কন্ট্রোল রুমের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে।

চলো এবার বোঝার চেষ্টা করি সমুদ্র গভীরে টাইটানের পারিপার্শ্বিক অবস্থা কেমন ছিলো। স্বাভাবিক অবস্থায় বায়ুমণ্ডল আমাদের উপর যে চাপ প্রয়োগ করে তার পরিমাণ হলো ১ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, কিন্তু সমুদ্রের ১৩,০০০ ফুট গভীরে পানি প্রায় ৪০০ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ প্রয়োগ করে। এই চাপ প্রতি বর্গমিটারে ৪২ লক্ষ কেজিরও বেশি যেখানে একজন স্বাভাবিক মানুষ পানির নিচে মাত্র ৫-৭ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ সহ্য করতে পারে।

টাইটান সাবমার্সিবলটি ধ্বংসের পেছনে বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ ধারণা করা হলেও বিস্ফোরণকেই প্রকৃত কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে বা বৈদ্যুতিক কারণে অগ্নিকান্ড ঘটলে কিংবা ভেতরের যেকোন একটি প্রেসার পাইপ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এ বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। টাইটানের গঠন উপাদান কার্বন ফাইবার হলো কার্বনের পলিমার যা হালকা কিন্তু ইস্পাতের তুলনায় ৫ গুণ শক্তিশালী। আর টাইটানিয়াম স্টিলের চেয়েও শক্তিশালী কিন্তু ওজন স্টিলের মাত্র ৪৫ শতাংশ। কিন্তু প্রচন্ড চাপে কার্বন ফাইবারে সামান্য একটু ভাজ থাকাই যথেষ্ট সম্পূর্ণ সাবমার্সিবলটিকে ধ্বংস (Implosion) করে দিতে। ধারণা করা হচ্ছে, অনুমোদনহীন যন্ত্রাংশ ব্যবহার কিংবা কয়েকবার সমুদ্র গভীরে ডুব দেওয়ার ফলে এতে হয়তো এমন ত্রুটি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সঠিক তদারকির অভাবে তা মেরামত করা হয়নি। এছাড়াও বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতে, সাবমার্সিবলটি যাত্রী নিয়ে সমুদ্রের এত গভীরে যাওয়ার মতো সক্ষম ছিল না। এটি ছিল পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি এবং লাইসেন্সবিহীন, যে কারণে ওশানগেট এর বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছিল।

অনেকেরই প্রশ্ন আসে যে, এ দুর্ঘটনার সময় এর ভেতরের যাত্রীরা কি অনুভব করেছিলেন বা তাদের মৃতদেহের কোনো অংশ উদ্ধার করা সম্ভব কি-না? বিজ্ঞানীদের মতে এ বিস্ফোরণের সময় ভেতরের বাতাস সংকুচিত ও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে এবং প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটবে। বিস্ফোরণটি ঘটতে সময় লাগে মাত্র ১ মিলিসেকেন্ড। ১ মি.সে. হলো ১ সেকেন্ডের ১০০০ ভাগের ১ ভাগ। অথচ আমাদের মস্তিষ্কের কোনো কিছু দেখার পর সে তথ্য প্রক্রিয়া করতে ১৩ মি.সে. সময় লাগে।

আবার ব্যথার অনুভূতি প্রক্রিয়াকরণ করতে সময় লাগে ১০০ মি.সে.। অর্থাৎ পুরো বিস্ফোরণটি এত কম সময়ে ঘটবে। যে যাত্রীরা হয়তো কিছুই টের পাবেন না। আর রুদ্ধতাপীয় সংকোচনের ফলে সাবমার্সিবলের তাপমাত্রা প্রায় সূর্যের তাপমাত্রার কাছাকাছি হবে। ফলে যাত্রীদের দেহের অংশাবশেষ পাওয়ার সম্ভাবনাও খুবই ক্ষীণ।



টাইটানের উদ্ধার অভিযানে বিভিন্ন দেশের উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় কয়েক হাজার মাইল সমুদ্রে খোঁজ চালানো হয় যার ব্যয় দাঁড়ায় কয়েক মিলিয়ন ডলার। এ কাজে অংশ নেয় উড়োজাহাজ, ডুবোজাহাজ, SONAR-সহ আধুনিক সব প্রযুক্তি। এতে টাইটান এর ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত করতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগলেও আমেরিকার নৌবাহিনীর একটি গোপন শব্দগ্রাহক যন্ত্রে কিছু শব্দ এসেছিল যা অনেকটা বিস্ফোরণের শব্দের মতো। তাই মনে করা হচ্ছে যে, সাবমার্সিবলটি তার কন্ট্রোল রুমের সাথে যোগাযোগ হারানোর পরেই বিস্ফোরিত হয়। আগেও বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের সাবমেরিন দুর্ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু গভীর সমুদ্রের প্রতি চিরায়ত আকর্ষণ মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। প্রতিনিয়তই দর্শনার্থীরা তাদের কৌতূহল মেটানোর জন্য বা বিজ্ঞানীরা গবেষণা কাজের জন্য সমুদ্র গভীরে যাত্রা করছেন। তবে অনেকেই মনে করছেন সমুদ্র গভীরে এত ঝুঁকিপূর্ণভাবে দর্শনার্থীদের ভ্রমণ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।

Source: BBC


{fullWidth}
© Mehrab360