হকিংস দিবসে জানুন তার জানা অজানা
© Mehrab360
স্টিফেন হকিং ছিলেন আধুনিক বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর প্রতিভা, যিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা ও মহাবিশ্ববিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এটি ছিল একটি বিশেষ দিন কারণ ঠিক ৩০০ বছর আগে একই দিনে মহান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। স্টিফেন হকিংয়ের বাবা ফ্রাঙ্ক হকিং একজন জীববিজ্ঞান গবেষক এবং মা ইসোবেল হকিং ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী। তাঁর শৈশব কাটে সেন্ট অ্যালবান্স শহরে, যেখানে তিনি সেন্ট অ্যালবান্স স্কুলে পড়াশোনা করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন কৌতূহলী, বিশেষত বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। তাঁর শিক্ষকদের মতে, যদিও স্কুল জীবনে তাঁর ফলাফল খুবই সাধারণ ছিল, কিন্তু জটিল বিষয়গুলো সহজে বুঝে নেওয়ার এক অনন্য ক্ষমতা তাঁর মধ্যে ছিল।
মেহরব৩৬০ চ্যানেল ফলো করুন
{fullWidth}
© Mehrab360
![]() |
পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং |
পরবর্তীতে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। শুরুতে তিনি গণিত পড়তে চেয়েছিলেন, কিন্তু অক্সফোর্ডে সে সময় গণিত বিষয়ে ডিগ্রি কোর্স ছিল না, তাই তিনি পদার্থবিদ্যা বেছে নেন। অক্সফোর্ডে থাকাকালীন তিনি ছিলেন খুবই উদাসীন, পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী ছিলেন না এবং পড়াশোনার বাইরে তিনি নৌকাবাইচসহ বিভিন্ন বিনোদনে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। তবুও, তিনি প্রথম শ্রেণির সম্মান নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কসমোলজি বা বিশ্বতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। এ সময়েই তাঁর জীবনে এক বড় ধাক্কা আসে। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি “অ্যামিওট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস (ALS)” বা মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হন। এটি একটি বিরল স্নায়বিক রোগ, যা ধীরে ধীরে শরীরের সব পেশী নিষ্ক্রিয় করে দেয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, তিনি হয়তো দুই থেকে তিন বছরের বেশি বাঁচবেন না। তবে সকল পূর্বাভাসকে ভুল প্রমাণ করে তিনি কয়েক দশক বেঁচে ছিলেন এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিপ্লব ঘটিয়েছেন।
স্টিফেন হকিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল সংক্রান্ত। তিনি দেখান যে ব্ল্যাক হোল সম্পূর্ণ নিঃশব্দ নয় বরং এটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিকিরণ নির্গত করে, যা পরবর্তীতে “হকিং রেডিয়েশন” নামে পরিচিত হয়। এর আগে ধারণা করা হতো ব্ল্যাক হোল থেকে কিছুই বের হতে পারে না, কিন্তু হকিং এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং প্রমাণ করেন যে ব্ল্যাক হোল থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, যা সময়ের সাথে সাথে ব্ল্যাক হোলকে সংকুচিত করে বিলীন করে দিতে পারে। এটি মহাকাশ বিজ্ঞান এবং কোয়ান্টাম ফিজিক্সের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার ছিল।
তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থ “A Brief History of Time” (সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস) ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়। এটি ছিল এমন একটি বই, যেখানে মহাবিশ্বের উৎপত্তি, সময়, ব্ল্যাক হোল এবং মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জন্য সহজ ভাষায় জটিল বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বইটি বিশ্বজুড়ে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং ৪০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এটি কয়েক কোটি কপি বিক্রি হয়েছে এবং দীর্ঘ সময় ধরে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় ছিল। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে “The Universe in a Nutshell”, “Black Holes and Baby Universes”, এবং “Brief Answers to the Big Questions” রয়েছে।
শারীরিকভাবে চরমভাবে অক্ষম হলেও হকিং তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং বিজ্ঞান জগতের বহু গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব প্রদান করেন। তিনি একটি বিশেষ কম্পিউটারভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে কথা বলতেন, যা তাঁর চোখের নড়াচড়া শনাক্ত করে শব্দে রূপান্তরিত করত। তাঁর এই প্রযুক্তির সহায়তায় তিনি বহু গবেষণা প্রকাশ করেন এবং বক্তৃতা প্রদান করেন।
স্টিফেন হকিংয়ের জীবন শুধু একজন বিজ্ঞানীর জীবনই নয়, বরং এটি অধ্যবসায়, মানসিক শক্তি এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি শারীরিকভাবে যতই সীমাবদ্ধ থাকুন না কেন, মানসিকভাবে তিনি ছিলেন অসীম। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যদি মনোবল দৃঢ় থাকে, তবে মানুষ অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে।
হকিং কেবল বিজ্ঞানী হিসেবেই খ্যাতি অর্জন করেননি, তিনি মানবজাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও গভীরভাবে চিন্তা করতেন। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন এবং বলেছিলেন, যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে তা মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে। একইভাবে, তিনি মহাকাশে মানব বসতি স্থাপনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, মানবজাতির টিকে থাকার জন্য পৃথিবীর বাইরে অন্য গ্রহে বসতি গড়া অপরিহার্য।
হকিং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন, পারমাণবিক যুদ্ধ এবং মহাজাগতিক হুমকি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মতে, মানবজাতি যদি আগামী এক হাজার বছর টিকে থাকতে চায়, তবে আমাদের অবশ্যই মহাকাশে ছড়িয়ে পড়তে হবে। স্টিফেন হকিংয়ের জীবনযাত্রা এবং কর্মজীবন তাঁকে অসামান্য খ্যাতি এনে দিয়েছে। তিনি রয়েল সোসাইটির ফেলো ছিলেন এবং যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার “অর্ডার অফ দ্য কম্প্যানিয়ন অফ অনার” লাভ করেন। তিনি ৩০টিরও বেশি সম্মানসূচক ডিগ্রি পেয়েছেন। তাঁর নামে অনেক বিজ্ঞানী গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তাঁর আবিষ্কার ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্য পথ দেখিয়ে চলেছে।
২০১৮ সালের ১৪ মার্চ স্টিফেন হকিং পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। মৃত্যুর পর তাঁকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের পাশে সমাধিস্থ করা হয়, যা তাঁর প্রতি বিজ্ঞান জগতের সর্বোচ্চ সম্মানের নিদর্শন। তাঁর সমাধিফলকে লেখা আছে তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ—হকিং রেডিয়েশনের সূত্র, যা মহাবিশ্বের প্রতি তাঁর অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখে।
হকিংয়ের মতে, মহাবিশ্বের একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব, সেটার অনুসন্ধান, অগ্রগতি সম্পর্কে সবারই জানার সুযোগ থাকা উচিত। অন্তত নীতিগতভাবে হলেও। এই চিন্তা থেকেই তিনি লিখেছেন বিখ্যাত বই অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম।{alertSuccess}
স্টিফেন হকিং একজন মানুষ যিনি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মানবজাতির জ্ঞানভান্ডারে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে সীমাবদ্ধতা মানসিক শক্তির সামনে কখনোই বাধা হতে পারে না। তিনি বিশ্বাস করতেন, “যদি জীবন কঠিন হয়ে ওঠে, তবে আপনি যদি কিছু করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন, তবে আপনি সফল হবেনই।” হকিং আমাদের জন্য শুধু একজন বিজ্ঞানী নন, তিনি এক চিরন্তন অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর জীবন, গবেষণা এবং চিন্তা ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের জন্য চিরকাল দিশারি হয়ে থাকবে।
{fullWidth}
ক্যাটাগরি
বিজ্ঞান