বিজ্ঞানীরা পানির নতুন রূপ তৈরি করেছে
© Mehrab360
পানি পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং রহস্যময় যৌগগুলোর মধ্যে একটি। এটি তরল, কঠিন ও গ্যাস—এই তিনটি অবস্থায় বিদ্যমান থাকলেও বিজ্ঞানীরা পানির আরও কিছু অস্বাভাবিক রূপ আবিষ্কার করেছেন, যা চরম পরিবেশে বা উচ্চ চাপের অধীনে গঠিত হয়। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা পানির একটি নতুন রূপ আবিষ্কার করেছেন, যার নাম “প্লাস্টিক আইস সেভেন” (Plastic Ice VII)। এটি একটি কঠিন বরফের রূপ, যা প্রচণ্ড উচ্চচাপে গঠিত হয় এবং স্বাভাবিক বরফের চেয়ে অনেক বেশি নমনীয় ও প্লাস্টিকের মতো আচরণ করে। এই নতুন বরফের আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি গ্রহ ও উপগ্রহের অভ্যন্তরীণ গঠন, গভীর সমুদ্রের পরিবেশ, এবং এমনকি এক্সোপ্ল্যানেটের (ভিনগ্রহের) অবস্থা সম্পর্কে নতুন ধারণা দিতে পারে।
মেহরব৩৬০ চ্যানেল ফলো করুন
ফলো করুন
{fullWidth}
© Mehrab360
![]() |
সংগৃহীত |
প্লাস্টিক আইস সেভেন হলো এক বিশেষ ধরনের বরফ, যা উচ্চচাপের কারণে স্বাভাবিক ক্রিস্টালাইন কাঠামো (গঠন) পরিবর্তন করে এবং নমনীয় হয়ে ওঠে। সাধারণ বরফ (যেমন আইস I) হিমাঙ্কের নিচে গঠিত হয় এবং একটি নির্দিষ্ট ছকবদ্ধ ক্রিস্টাল কাঠামো রাখে। তবে আইস VII (Ice VII) এক ধরনের উচ্চচাপীয় বরফ, যা অত্যন্ত চাপে এবং তুলনামূলকভাবে উচ্চ তাপমাত্রায় গঠিত হয়। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন যে, যদি আইস VII-কে আরও চাপে ফেলা হয়, তাহলে এটি আরও বেশি নমনীয় হয়ে যায় এবং প্লাস্টিকের মতো আচরণ করে, যার ফলে একে “প্লাস্টিক আইস সেভেন” বলা হয়।
বিজ্ঞানীরা এই নতুন বরফ তৈরি করতে উচ্চচাপযুক্ত ল্যাবরেটরি পরিবেশ ব্যবহার করেছেন। সাধারণত, উচ্চচাপ বরফ তৈরির জন্য ডায়মন্ড অ্যানভিল সেল (Diamond Anvil Cell) ব্যবহার করা হয়, যা দুটি হীরার মধ্যে নমুনাকে সংকুচিত করে প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করে। গবেষকরা পানির উপর কয়েক লক্ষ অ্যাটমোস্ফিয়ার (গণবায়ু) চাপ প্রয়োগ করেন, যা পৃথিবীর গভীর অভ্যন্তরে বা বৃহস্পতি ও শনির মতো গ্রহের গভীর স্থরে থাকা পরিবেশের অনুরূপ। এই চাপে আইস VII-এর কাঠামো পরিবর্তিত হয়ে প্লাস্টিক আইস সেভেন তৈরি হয়, যা স্বাভাবিক ক্রিস্টাল বরফের মতো শক্ত নয়, বরং এটি একটি নমনীয় ও সহজেই আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে এমন কাঠামো ধারণ করে।
প্লাস্টিক আইস সেভেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি স্বাভাবিক বরফের মতো ভঙ্গুর নয় বরং এটি নমনীয় এবং উচ্চচাপে সহজেই আকার পরিবর্তন করতে পারে। সাধারণ বরফের কণা বা অণুগুলো একটি নির্দিষ্ট ছকবদ্ধ বিন্যাসে থাকে, কিন্তু প্লাস্টিক আইস সেভেনে এই কাঠামোটি কিছুটা শিথিল এবং পরিবর্তনশীল হয়। এই ধরনের বরফের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হলো এটি খুব উচ্চচাপে গঠিত হয় এবং অত্যন্ত তাপ সহনশীল হতে পারে। এর ফলে এটি শুধুমাত্র পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ স্তরে নয়, বরং বৃহস্পতি, ইউরোপা, গ্যানিমিড, এবং শনির টাইটান ও এনসেলাডাস উপগ্রহের গভীর মহাসাগরীয় স্তরেও থাকতে পারে। তাই, এই নতুন ধরনের বরফ আমাদের সৌরজগতের জলভাগ এবং অন্যান্য গ্রহের সম্ভাব্য বাসযোগ্য পরিবেশ সম্পর্কে নতুন তথ্য দিতে পারে।
প্লাস্টিক আইস সেভেনের আবিষ্কার মহাকাশ গবেষণার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে বৃহস্পতি ও শনির উপগ্রহগুলোর বরফে ঢাকা মহাসাগরগুলোর গভীরে এই ধরনের বরফ থাকতে পারে। যদি সত্যিই এমন হয়, তাহলে এর অর্থ হলো যে আমাদের সৌরজগতে পানির উপস্থিতি এবং তার গঠন সম্পর্কে পূর্ববর্তী ধারণাগুলোর পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এছাড়াও, এই বরফ এক্সোপ্ল্যানেট (ভিনগ্রহ) গবেষণার ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। যেসব গ্রহ বিশাল মহাসাগরে আবৃত এবং উচ্চচাপযুক্ত পরিবেশে রয়েছে, সেখানে প্লাস্টিক আইস সেভেনের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এই গবেষণা ভবিষ্যতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনা সম্পর্কে নতুন তথ্য দিতে পারে।
এই নতুন ধরনের বরফ শুধু মহাকাশ গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি প্রযুক্তি ও শিল্পক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে। যেহেতু এটি প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে পারে এবং নমনীয় প্রকৃতির, তাই এটি উচ্চচাপযুক্ত পরিবেশে উপযোগী উপকরণ তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশেষ করে, এটি ভবিষ্যতের গভীর সমুদ্র অনুসন্ধান, উন্নত কুলিং সিস্টেম, এবং উচ্চচাপ প্রযুক্তির জন্য নতুন উপাদান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্লাস্টিক আইস সেভেনের আবিষ্কার পানির রহস্যময় গঠন সম্পর্কে নতুন ধারণা দিয়েছে। এটি কেবল বরফের একটি নতুন রূপ নয়, বরং মহাকাশ গবেষণা, উপগ্রহ ও গ্রহের অভ্যন্তরীণ কাঠামো এবং উচ্চচাপ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচন করতে পারে। পৃথিবী ছাড়াও মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পানির অস্তিত্ব কেমন হতে পারে, তা বুঝতে এই গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই নতুন ধরনের বরফের বৈশিষ্ট্য এবং সম্ভাব্য ব্যবহার সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। এর ফলে, এটি আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানার পথ আরও প্রশস্ত করবে এবং নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করবে।
ক্যাটাগরি
বিজ্ঞান