বঙ্গাব্দ
© Mehrab360

মহাবিশ্বের রহস্যময় শক্তি কি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে?

© Mehrab360
মহাবিশ্বের সম্প্রসারণকে চালিত করা রহস্যময় শক্তি "ডার্ক এনার্জি" সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নতুন এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার কিট পিক ন্যাশনাল অবজারভেটরির গবেষণায় দেখা গেছে, এই ডার্ক এনার্জি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্বল হয়ে যেতে পারে। যদি এই গবেষণা নিশ্চিত হয়, তবে এটি মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণাকে আমূল বদলে দিতে পারে। এতদিন বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন, মহাবিশ্ব চিরকাল সম্প্রসারিত হবে এবং একসময় এটি একটি নিঃসঙ্গ, শীতল পরিস্থিতিতে পৌঁছাবে, যা "বিগ ফ্রিজ" নামে পরিচিত। কিন্তু নতুন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ডার্ক এনার্জি এখন আর আগের মতো শক্তিশালী নয় এবং এটি ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে মহাবিশ্ব সংকুচিত হয়ে "বিগ ক্রাঞ্চ" নামে একটি বিপরীত মহাবিস্ফোরণে পরিণত হতে পারে।

সংগৃহীত | theguardian.com

১৯৯০-এর দশকের শেষভাগে বিজ্ঞানীরা সুদূরবর্তী সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের গতি ধীরে ধীরে কমার বদলে দ্রুততর হচ্ছে। এই বিস্ময়কর পর্যবেক্ষণ থেকেই "ডার্ক এনার্জি" ধারণাটির জন্ম। তত্ত্ব অনুসারে, এই ডার্ক এনার্জি মহাবিশ্বের প্রায় ৭০% অংশ দখল করে রেখেছে, বাকিটা ডার্ক ম্যাটার এবং সাধারণ পদার্থ। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন, এই শক্তি একটি ধ্রুবক বা অপরিবর্তনীয় এবং এটি মহাবিশ্বকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত সম্প্রসারিত রাখবে। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, এই শক্তি সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে, যা মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন তৈরি করেছে।

কিট পিক ন্যাশনাল অবজারভেটরির "ডার্ক এনার্জি স্পেকট্রোস্কোপিক ইন্সট্রুমেন্ট (Desi)" প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের ইতিহাসকে বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। Desi-এর ৫,০০০টি অপটিক্যাল সেন্সর ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা ১৫ মিলিয়নেরও বেশি গ্যালাক্সির তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এই বিশাল ডেটা সেট থেকে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, মহাবিশ্বের বর্তমান বয়সের প্রায় ৭০% সময়ে ডার্ক এনার্জি সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। তবে এখন এটি প্রায় ১০% হ্রাস পেয়েছে। এই ফলাফল ইঙ্গিত দেয় যে, ডার্ক এনার্জি আর আগের মতো শক্তিশালী নয় এবং এর ফলে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হার কিছুটা ধীর হচ্ছে। যদিও এখনও সম্প্রসারণের হার বাড়ছে, তবে ডার্ক এনার্জি ধীরে ধীরে তার শক্তি হারাচ্ছে। যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে এটি মহাবিশ্বকে সংকুচিত করে এক সময়ে "বিগ ক্রাঞ্চ" পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।

Desi প্রকল্পের সহ-সমন্বয়ক এবং ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, সান্তা ক্রুজ-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রফেসর অ্যালেক্সি লোথো-হার্নেট বলেছেন, "আমরা এমন কিছু পর্যবেক্ষণ করছি যা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। আমরা সম্ভবত ডার্ক এনার্জি এবং মহাবিশ্বের মৌলিক প্রকৃতি সম্পর্কে এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে রয়েছি।" এই গবেষণার আরেক সদস্য ইউনিভার্সিটি অফ ডারহামের অধ্যাপক কার্লোস ফ্রেঙ্ক বলেন, "আমাদের পর্যবেক্ষণ থেকে পরিষ্কার যে কিছু একটা গ্যালাক্সিগুলোকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, তবে তা অপরিবর্তনীয় নয়। এটি সময়ের সাথে দুর্বল হচ্ছে।"

এই গবেষণা যদি আরও নিশ্চিত হয়, তবে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলো বদলে যাবে। এতদিন ধরে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, মহাবিশ্ব চিরকাল সম্প্রসারিত হবে এবং শেষ পর্যন্ত সমস্ত গ্যালাক্সি একে অপরের থেকে এত দূরে চলে যাবে যে আলোও আর তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে না। এই পরিস্থিতি "বিগ ফ্রিজ" নামে পরিচিত। কিন্তু যদি ডার্ক এনার্জি দুর্বল হতে থাকে এবং নেতিবাচক পর্যায়ে পৌঁছায়, তাহলে মহাবিশ্ব তার সম্প্রসারণ থামিয়ে সংকুচিত হতে শুরু করবে। এই সংকোচন এক সময় মহাবিশ্বকে তার প্রাথমিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, যাকে "বিগ ক্রাঞ্চ" বলা হয়।

যদিও এই গবেষণার ফলাফল চাঞ্চল্যকর, তবে এটি এখনও পদার্থবিজ্ঞানের "ফাইভ-সিগমা" মানদণ্ড পূরণ করেনি। ফাইভ-সিগমা হলো এমন একটি পরিমাপ যা কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে নিশ্চিত করার জন্য স্বীকৃত মানদণ্ড। ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবার্গ-এর অধ্যাপক জন পিকক, যিনি আগে এই ধারণার প্রতি সন্দিহান ছিলেন, এখন বিশ্বাস করেন এই গবেষণার ভিত্তি শক্ত। তিনি বলেন, "চরম দাবি করতে হলে চরম প্রমাণের প্রয়োজন। এই ফলাফলের সত্যতা সম্পর্কে আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী।" তবে কিছু বিজ্ঞানী এখনো সতর্ক। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যামব্রিজের অধ্যাপক জর্জ ইফস্টাথিও বলেন, "এই পর্যবেক্ষণ এখনো চূড়ান্ত প্রমাণ নয়। কিন্তু Desi যদি আরও বেশি তথ্য সংগ্রহ করে, তাহলে এটি নিশ্চিত হতে পারে।"

এই গবেষণার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো ডার্ক এনার্জি কেন দুর্বল হচ্ছে? বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না এটি পদার্থবিজ্ঞানের প্রচলিত সূত্রগুলির বাইরে নতুন কিছু ইঙ্গিত করছে কি না। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ওফের লাহাভ বলেন, "আমরা এখনো জানি না ডার্ক ম্যাটার বা ডার্ক এনার্জি কী। এটি যথেষ্ট জটিল। তবে আপনি যদি ইতিবাচকভাবে চিন্তা করেন, তাহলে এটা স্পষ্ট যে, আমরা নতুন কিছু জানার দ্বারপ্রান্তে রয়েছি।" Desi-এর সাম্প্রতিক গবেষণা আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে বহু প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ডার্ক এনার্জির দুর্বল হওয়ার ইঙ্গিত যদি নিশ্চিত হয়, তবে এটি আমাদের মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করবে। মহাবিশ্ব কি চিরকাল সম্প্রসারিত হবে, নাকি একসময় সংকুচিত হয়ে "বিগ ক্রাঞ্চ"-এ রূপ নেবে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা আরও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। Desi প্রকল্প থেকে আরও তথ্য আসার অপেক্ষায় রয়েছে গোটা বিশ্ব।
{fullWidth}
© Mehrab360