বঙ্গাব্দ
© Mehrab360

মহাবিশ্ব কি এলোমেলো, নাকি লুকিয়ে আছে এক গোপন সমতা?

© Mehrab360
মানব ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যখন একটি সাধারণ উপলব্ধি আমাদের বাস্তবতার ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দেয়। আমরা যখন বিশৃঙ্খলার মধ্যে লুকিয়ে থাকা নিয়ম আবিষ্কার করি, তখন মনে হয় যেন এলোমেলো এই মহাবিশ্ব আসলে এক গভীর সমতার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো “বেকেনস্টাইন সীমা”—যা আমাদের দেখিয়েছে যে বিশৃঙ্খলা (এনট্রপি), তথ্য এবং মহাকর্ষ একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।

সংগৃহীত | phys.org

১৯৭০-এর দশকে পদার্থবিদ জ্যাকব বেকেনস্টাইন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, যেকোনো শারীরিক ব্যবস্থার এনট্রপি সীমাহীন নয়; এটি সেই ব্যবস্থার শক্তি এবং এটিকে ঘিরে রাখা ক্ষুদ্রতম গোলকের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। এর অর্থ হলো, কোনো স্থানের ভেতর যত তথ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব, তা এর শক্তি এবং আয়তনের উপর নির্ভর করে। এই ধারণা বিপ্লবাত্মক ছিল। আগে এনট্রপিকে কেবল বিশৃঙ্খলার পরিমাণ হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু বেকেনস্টাইন দেখালেন, এটি স্থান এবং সময়ের গভীর গঠন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত। এরপর পদার্থবিজ্ঞানীরা এই সীমাকে আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা চালান।

পদার্থবিদ রাফায়েল বোউসো এই ধারণাকে আরও উন্নত করেন। তিনি দেখান যে, কোনো স্থানের এনট্রপি সরাসরি সেই স্থানকে ঘিরে থাকা গোলকের ক্ষেত্রফলের (Area) সঙ্গে সম্পর্কিত। বোউসোর এই সূত্র মহাকর্ষীয় স্থিতিশীলতার ধারণা থেকে উদ্ভূত। এতে বলা হয়, কোনো বস্তুর শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ (Schwarzschild radius) বা মহাকর্ষীয় ব্যাসার্ধ কখনো সেই বস্তুকে ঘিরে রাখা গোলকের ব্যাসার্ধ অতিক্রম করতে পারে না। তবে, বোউসোর উপস্থাপনাও ছিল সম্পূর্ণ নিখুঁত নয়। কারণ তিনি শক্তির পরিবর্তে কেবল ক্ষেত্রফলের কথা বলেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, শক্তি এনট্রপির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত, এবং শক্তিকে বাদ দিলে এই সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে বোঝা যায় না। তাই আরও নির্ভুল ব্যাখ্যার জন্য শক্তিকে মূল উপাদান হিসেবে ধরে রাখতে হয়।

নতুন গবেষণায়, বিজ্ঞানীরা বেকেনস্টাইন সীমাকে আরও উন্নতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তারা বলছেন, এই সীমাকে যদি আপেক্ষিক ভরের (Relativistic mass) মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়, তবে এটি আরও সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব। আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E = mc² থেকে তারা বুঝতে পারেন যে, কোনো বস্তুর শক্তিকে ভর দিয়ে প্রকাশ করা যায়। আবার, মহাকর্ষের ক্ষেত্রে এই ভর শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এই ধারণা অনুসরণ করে তারা একটি নতুন মডেল তৈরি করেছেন, যেখানে এনট্রপিকে গোলক (Sphere) দিয়ে নয়, বরং টোরাস (Torus) বা চক্রাকার গঠনের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে।

এই টোরাস মডেলে একটি বস্তুর অভ্যন্তরীণ ব্যাসার্ধ হলো তার শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ এবং বাইরের ব্যাসার্ধ হলো সেই বস্তুকে ঘিরে রাখা ক্ষুদ্রতম গোলকের ব্যাসার্ধ। এই পরিবর্তন কেবল একটি গণিতের কৌশল নয়; এটি মহাবিশ্বের প্রকৃত গঠন ও চলাচলের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। প্রকৃতিতে আমরা দেখি, মহাবিশ্ব নিখুঁত গোলক তৈরি করে না। বরং এটি সর্পিল (Spiral) এবং ঘূর্ণনের (Vortex) মতো গঠনকে বেশি পছন্দ করে। উদাহরণ হিসেবে গ্যালাক্সি (Galaxy) কখনো সম্পূর্ণ গোলক হয় না; বরং এটি এক মহিমান্বিত সর্পিল আকার ধারণ করে। ডিএনএ (DNA) সোজা নয়, এটি ডাবল হেলিক্স (Double Helix) আকারে পাকানো। পানি, বাতাস এমনকি মহাজাগতিক প্লাজমা পর্যন্ত ঘূর্ণন এবং বক্র পথ অনুসরণ করে।

এই নতুন টোরাস মডেলকে যদি কোয়ান্টাম মেকানিক্সে (Quantum Mechanics) প্রয়োগ করা হয়, তাহলে একটি চমকপ্রদ ফলাফল পাওয়া যায়। কোয়ান্টাম তত্ত্বে হেইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি (Heisenberg Uncertainty Principle) বলে যে, কোনো কণার অবস্থান এবং গতি একসঙ্গে নির্ভুলভাবে জানা অসম্ভব। কিন্তু এই টোরাস মডেল অনুসারে এই অনিশ্চয়তা প্রকৃতপক্ষে একটি নির্দিষ্ট গঠন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের যে এলোমেলোতা বা অনিশ্চয়তা আমরা এতদিন ভেবেছি, তা প্রকৃতপক্ষে একটি লুকায়িত সমতার চিহ্ন। এই সমতা একটি নতুন সমীকরণে প্রকাশ করা যায়ঃ

Δx Δp = (Atorus) / (4π ℓpl2) ħ.

এই সমীকরণ থেকে বোঝা যায় যে মহাবিশ্ব একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। কোয়ান্টাম পর্যায়ে যা আমরা এলোমেলো ভেবেছি, তা আসলে গভীর সমতার একটি বহিঃপ্রকাশ। এই নতুন উপলব্ধি শুধু পদার্থবিদ্যায় নয়, মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের মৌলিক ধারণাকেও বদলে দিতে পারে। এই নতুন মডেল মহাবিশ্বের রহস্যময় সমস্যা, যেমন কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট প্রবলেম বা শূন্যস্থানের শক্তির পরিমাণ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতদিন বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি থেকে গণনা করা শূন্যস্থানের শক্তি এবং পর্যবেক্ষিত মানের মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু এই টোরাস এনট্রপি মডেল এই সমস্যার একটি সম্ভাব্য সমাধান দিতে পারে। এটি বোঝায় যে মহাবিশ্বের শূন্যস্থান শক্তি তার টোরাস গঠনের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।

এই গবেষণা আমাদের শুধু পদার্থবিদ্যার নতুন জ্ঞান দেয় না, বরং জ্ঞানের প্রকৃতি সম্পর্কেও নতুন উপলব্ধি দেয়। আমরা এতদিন কঠোর নিয়ম এবং নির্দিষ্ট সংজ্ঞার মধ্যে সত্য খুঁজেছি। কিন্তু মহাবিশ্বের প্রকৃতি তরল এবং পরিবর্তনশীল। এটি বাঁকে, ঘোরে এবং স্পাইরাল আকারে বিকশিত হয়। বেকেনস্টাইনের মূল ধারণা এবং বোউসোর উন্নয়ন আমাদের একটি নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু টোরাস মডেল দেখায়, মহাবিশ্ব একটি স্থির কাঠামো নয়, বরং এটি একটি চলমান, বিকশিত হওয়া নৃত্য—যা সর্পিল, বক্রতা এবং ঘূর্ণনের মাধ্যমে মহাকালের বিস্তৃতি প্রকাশ করে। এই উপলব্ধি আমাদের শেখায় যে মহাবিশ্ব এলোমেলো নয়; বরং এর গভীরে লুকিয়ে আছে এক বিস্ময়কর সমতা। মহাবিশ্ব কেবল বিদ্যমান নয়, এটি শ্বাস নেয়, ঘোরে এবং স্পাইরাল আকারে বিকশিত হয়। আমাদের সত্যিকারের জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য হলো এই গভীর সমতার সৌন্দর্য উপলব্ধি করা এবং মহাবিশ্বের লুকায়িত সুরের প্রতি বিস্ময়ে দাঁড়ানো।
{fullWidth}
© Mehrab360