বৃত্ত কেন ৩৬০ ডিগ্রি?
© Mehrab360
ফলো করুন
{fullWidth}
© Mehrab360
বৃত্তের পরিধি কেন ৩৬০ ডিগ্রিতে বিভক্ত, এটি একটি প্রাচীন এবং রহস্যময় গণিতীয় সিদ্ধান্ত। যদিও এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিক মনে হয়, কিন্তু এর পেছনে ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত এবং সভ্যতার বিকাশের একটি চমকপ্রদ গল্প রয়েছে। আজ আমরা এই রহস্যের গভীরে যাব এবং জানব কেন বৃত্তকে ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করা হয়েছে।
৩৬০ ডিগ্রির ধারণাটি মূলত এসেছে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতা থেকে, যা আনুমানিক ২০০০ খ্রিস্টপূর্বে গড়ে ওঠে। ব্যাবিলনীয় গণিতজ্ঞরা একটি ষাটভিত্তিক (sexagesimal) গণনাপদ্ধতি ব্যবহার করতেন। আজ আমরা দশমিক পদ্ধতি (base-10) ব্যবহার করি, কিন্তু ব্যাবিলনীয়রা ৬০ ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে গণনা করতেন। এটি তারা মূলত জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য ব্যবহার করতেন, কারণ তারা রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করে সময় এবং দিক নির্ণয় করতেন। তারা দেখতে পান যে, সূর্য এক বছরে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে এবং বছরে প্রায় ৩৬৫ দিন থাকে। তবে ৩৬০ একটি সহজ ও সম্পূর্ণ সংখ্যা ছিল, যা ৬০ দ্বারা বিভাজ্য এবং অনেক সংখ্যার সাথে সহজে ভাগ করা যায়। ফলে তারা বৃত্তকে ৩৬০ অংশে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন।
ব্যাবিলনীয়দের দেখানো পথে পরবর্তী গ্রিক এবং ভারতীয় গণিতজ্ঞরা এই ধারণাকে আরও বিকশিত করেন। প্রাচীন গ্রিক বিজ্ঞানী হিপারকাস (Hipparchus) এবং টলেমি (Ptolemy) জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মানচিত্র অঙ্কনে ৩৬০ ডিগ্রির ধারণা ব্যবহার করেন। তারা দেখেন যে, পৃথিবী ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘূর্ণন করে, এবং প্রতি ঘণ্টায় ১৫ ডিগ্রি করে অক্ষাংশ পরিবর্তন হয় (২৪ × ১৫ = ৩৬০)। এছাড়াও, ভারতীয় জ্যোতির্বিদরা (যেমন আর্যভট্ট) গণনা করে দেখেছিলেন যে, চাঁদের গতিবিধি ও সময় পরিমাপেও ৩৬০ ডিগ্রি একটি কার্যকর সংখ্যা।
৩৬০ ডিগ্রির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি অনেক সংখ্যার দ্বারা বিভাজ্য। ৩৬০-এর ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৮, ৯, ১০, ১২, ১৫, ১৮, ২০, ৩০, ৪০, ৪৫, ৬০, ৭২, ৯০, ১২০, ১৮০-এর মতো বহু বিভাজক রয়েছে। ফলে জ্যামিতিক গণনায় এটি সহজেই ব্যবহার করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি সমবাহু ত্রিভুজের প্রতিটি কোণ ৬০ ডিগ্রি হয় (৩৬০ ÷ ৬ = ৬০), একটি চতুর্ভুজের কোণের সমষ্টি ৩৬০ ডিগ্রি হয় এবং একটি পঞ্চভুজের প্রতিটি বাহুর কোণ ৭২ ডিগ্রি হয় (৩৬০ ÷ ৫ = ৭২)। এসব কারণে, জ্যামিতিতে ৩৬০ ডিগ্রির ব্যবহার খুবই কার্যকর ও সাধারণ হয়ে উঠেছে।
আজকের যুগেও ৩৬০ ডিগ্রি ধারণা বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। কম্পাসের দিকনির্দেশনায় উত্তরকে ০° ধরা হয়, এবং দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমসহ বিভিন্ন দিক ৩৬০ ডিগ্রির মধ্যে বিভক্ত থাকে। এছাড়া, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (GPS), নেভিগেশন, রোবটিক্স এবং কম্পিউটার গ্রাফিক্সেও ৩৬০ ডিগ্রি ব্যবহৃত হয়। এমনকি, আমাদের দৈনন্দিন কথোপকথনেও “৩৬০ ডিগ্রি পরিবর্তন” কথাটি ব্যবহার করা হয়, যার অর্থ হলো সম্পূর্ণ ঘুরে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া।
বৃত্তের ৩৬০ ডিগ্রিতে বিভক্ত হওয়া কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এটি প্রাচীন গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল এবং সভ্যতার বিকাশের সাথে সম্পর্কিত। ব্যাবিলনীয়দের ষাটভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি, পৃথিবীর আবর্তন, এবং জ্যামিতির সুবিধার কারণে ৩৬০ ডিগ্রি একটি আদর্শ সংখ্যা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আজকের প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানেও এই ব্যবস্থাটি অপরিবর্তিত রয়ে গেছে, যা প্রমাণ করে যে, হাজার বছর আগের এই গণিতগত সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর ছিল।
{fullWidth}
ক্যাটাগরি
বিজ্ঞান